এবার ঢাকায় বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন
বিশেষ প্রতিনিধি : অবশেষে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ভোগান্তি থেকে মুক্তি পেতে যাচ্ছে ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) বাসিন্দারা। ডিএনসিসি আমিনবাজার এলাকায় বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য একটি কেন্দ্র স্থাপনের চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে সরকার। দেশে এটিই প্রথম এই জাতীয় প্রকল্প।
৪২ দশমিক ৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণকাজ করবে চায়না মেশিনারি ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিএমইসি)। এর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ৩২৫ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। সম্প্রতি সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত কমিটিতে চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়ায় দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে বলে মন্তব্য করেছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম।
এটি বাস্তবায়ন হলে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় এ রকম প্রকল্পের উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। আর এর মাধ্যমে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের জন্য নতুন দ্বার উন্মোচন হতে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। কঠিন এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে যেকোনো চ্যালেঞ্জ নিতেও রাজি আছেন ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম। ফলে এই প্রকল্পটির বাস্তবায়ন হলে দেশের বিদ্যুৎ খাতে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিদ্যুৎ বিভাগ ও ডিএনসিসি সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এবং প্রক্রিয়াকরণ কমিটির সুপারিশের প্রেক্ষিতে প্রাইভেট সেক্টর পাওয়ার জেনারেশন পলিসির আওতায় বিওও ভিত্তিতে আইপিপি হিসেবে চায়না মেশিনারি ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিএমইসি) ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ৪২ দশমিক ৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার বর্জ্য বিদ্যুৎকেন্দ্রে ‘নো ইলেকট্রিসিটি, নো পেমেন্ট’-এর ভিত্তিতে ইনসিনারেশন পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে, যা বাস্তবায়ন করা হবে আগামী ২০ মাসের মধ্যে।
২৫ বছর মেয়াদি এ চুক্তির প্রেক্ষিতে স্পন্সর কোম্পানি নিজ ঝুঁকিতে প্লান্ট স্থাপন, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বহন এবং বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বিক্রির মাধ্যমে তাদের ব্যয় নির্বাহ করবে। এতে সিটি করপোরেশন প্লান্ট স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জমির সংস্থান এবং নিয়মিত বর্জ্য সরবরাহ করবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, প্লান্টটি চালু হলে সেখানে প্রতিদিন ৩ হাজার টন বর্জ্য সরবরাহ করতে হবে। এ পরিমাণ বর্জ্য সরবরাহ করতে না পারলে উত্তর সিটি করপোরেশনকে প্রতি টন ঘাটতি বর্জ্যরে জন্য ১ হাজার টাকা হারে স্পন্সর কোম্পানিকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে।
যেহেতু প্রতিদিন ৩ হাজার টন বর্জ্য প্রয়োজন হবে তাই এ পরিমাণ বর্জ্য সংগ্রহ করতে হলে আর যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকবে না। এ প্রক্রিয়ায় বর্জ্য প্রায় সম্পূর্ণরূপে দহন করে বর্জ্যরে আয়তন প্রায় ৯০ শতাংশ হ্রাস করা সম্ভব এবং এর ফলে বর্জ্য ফেলার জমির চাহিদা হ্রাস পাবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, বিদ্যুৎকেন্দ্র ইনসিনারেশন প্রযুক্তি প্রয়োগে বর্জ্যরে দহনের মাধ্যমে সৃষ্ট গ্যাসীয় নিঃসরণ মান কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে। গ্রহণ করা হবে ইইউ/২০১০/৭৫ইইউ মানদণ্ড যা বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ১৯৯৭-এর মানদণ্ড থেকে বেশি পরিবেশবান্ধব এবং বর্তমানে উন্নত দেশগুলোতে অনুসরণ করা হচ্ছে। প্রকল্পটির সফলভাবে বাস্তবায়ন হলে দেশের সব সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও জেলা পর্যায়ে ইনসিনারেশন পদ্ধতিতে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে সরকার।
জানা যায়, বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের বিশেষ উদ্যোগে গৃহীত প্রকল্প এটি, যা বৃহস্পতিবার সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি অনুমোদন দিয়েছে। কমিটি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ইনসিনারেশন পদ্ধতিতে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিদ্যুৎ বিভাগের প্রস্তাবটি অনুমোদন করে।
এ ব্যাপারে মন্ত্রী তাজুল ইসলাম জানান, দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে ঢাকা শহরের অন্যতম সমস্যা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ গ্রহণ করি। বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য দফায় দফায় সিটি করপোরেশন, পৌরসভা এবং অন্যান্য স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক সভা করেছি। এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জনের লক্ষ্যে যেসব দেশ বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে এমন বেশ কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করার পাশাপাশি এ বিষয়ে অভিজ্ঞ দেশি-বিদেশিদের মতামতও নিয়েছি। আশা করছি আগামী বছরের শুরুতেই প্রকল্পের কাজ শুরু করতে পারব আমরা। এই প্রকল্পটির সফল বাস্তবায়ন হলে দেশের সব সিটি করপোরেশন, পৌরসভা এবং জেলা পর্যায়ে ইনসিনারেশন পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে সরকার।
এদিকে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে বলে মন্তব্য করেছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি জানান, বর্তমানে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে ৬৫০ দশমিক ১৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হলেও তা যথেষ্ট নয়। জল, সৌর ও বায়ু থেকে ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। আর এবার বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা। এতে করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বর্জ্য থেকে চীনা কোম্পানি নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের ক্ষেত্রে নতুন দ্বার উন্মোচন করবে বলে আমি মনে করি।
তিনি আরও জানান, বর্তমানে সৌর উৎস থেকে ৪১৬ দশমিক ২২ মেগাওয়াট, বায়ু থেকে ২ দশমিক ৯ মেগাওয়াট ও জলবিদ্যুৎ থেকে ২৩০ মেগাওয়াট, বায়ুগ্যাস থেকে ০ দশমকি ৬৩ মেগাওয়াট, বায়ুম্যাস থেকে ০ দশমিক ৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে।
চায়না মেশিনারি ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন নিজ খরচে অ্যাশ ইয়ার্ড নির্মাণের জন্য অতিরিক্ত প্রায় ২০ একর জমি ক্রয়, প্রায় ১২ কিমি ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইন ও জিআইএস বে তৈরি করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৪২ দশমিক ৫ মেগাওয়াট বর্জ্য বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করবে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন স্পন্সর কোম্পানিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ৩০ একর জমি ও দৈনিক ৩ হাজার টন বর্জ্য সরবরাহ করবে। নো ইলেকট্রিসিটি, নো পেমেন্টের ভিত্তিতে স্থাপনকৃত এই কেন্দ্রের প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ১৮ দশমিক ২৯৫ টাকা ক্রয় করা হবে।
এত পরিমাণ বর্জ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হবে কি না, জানতে চাইলে ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম সময়ের আলোকে জানান, প্রকল্পটির কাজ শুরু হতে আরও কিছুটা সময় আছে। এর মধ্যে আমাদের নতুন যুক্ত হওয়া ওয়ার্ডগুলোতে পুরোদমে বর্জ্য সংগ্রহ শুরু হলে বর্জ্যরে পরিমাণ বাড়বে। আমাদের এখন বিপুল পরিমাণ বর্জ্য আমিনবাজারে রয়েছে।
এ ছাড়া সাভার থেকেও ময়লা সংগ্রহ করতে পারি। আমাদের ময়লার কোনো ঘাটতি হবে না। তিনি বলেন, দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই আমরা এটি বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা মোতাবেক আমরা কাজ করছি। এর বাস্তবায়নে যেকোনো চ্যালেঞ্জ নিতে আমরা প্রস্তুত আছি।