১৯৭৫ এবং ২০২৪ আওয়ামী লীগের জন্য যে পরিস্থিতি নিয়ে এসেছে
তখন কোনো ধরনের প্রতিরোধ ছাড়াই পুরো বাড়ির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সপরিবারে মি. রহমানকে হত্যা করে হত্যাকারীরা।
শেখ মুজিবুর রহমানের দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় তখন বেঁচে গিয়েছিলেন।
এ ঘটনায় কার্যত তছনছ হয়ে পড়েছিল আওয়ামী লীগ। এর জের ধরে পরে তখন সারাদেশে চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়ে দলটি।
তখন সে বাড়ির নিচতলায় একটি কক্ষে কর্মরত ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত সহকারী এ এফ এম মুহিতুল ইসলাম। মুহিতুল ইসলাম ২০১৬ সালে মারা যান। ১৯৯৬ সালে তিনি শেখ মুজিব হত্যা মামলার বাদী হয়েছিলেন।
২০১০ সালে বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মি. ইসলাম বলেছিলেন, “একজন রাষ্ট্রপতির বাড়িতে যে ধরনের নিরাপত্তা থাকা দরকার সেটি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে ছিল না। তাছাড়া রাষ্ট্রপতির বাড়িতে আক্রমণের পরেও কোনো তরফ থেকে কোনো ধরনের সহায়তা আসেনি।”
হত্যাকাণ্ডের পর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটি অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত সেনাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। তৎকালীন আওয়ামী লীগেরই একজন সিনিয়র নেতা এবং মন্ত্রিপরিষদের সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন।
এরপর আওয়ামী লীগের যারা মোশতাক সরকারকে সমর্থন করেননি তারা অনেকে আত্মগোপনে যান। অনেক নেতা পরবর্তীতে আটক হয়ে দীর্ঘসময় ধরে কারাভোগ করেন। অনেকে ভারতে চলে যান।
পরবর্তী আব্দুল কাদের সিদ্দিকীসহ কেউ কেউ আবার প্রতিরোধ তৈরির চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।
সে বছর ১৫ই অগাস্টের আগে শেখ মুজিবুর রহমান কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশাল পদ্ধতি প্রবর্তন করেছিলেন।
পরে ১৯৭৬ সালে রাজনৈতিক দলগুলো নিবন্ধনের সুযোগ পেলে তখন আবার আওয়ামী লীগ নামেই দলটি নিবন্ধিত হয়ে রাজনীতি শুরু করেছিলো।
মহিউদ্দিন আহমদ বলছেন, আওয়ামী লীগ নামে দলটি আবার ফিরে আসলো ১৯৭৬ সালে।
“তবে শেখ মুজিব ছাড়া দ্বিতীয় কোনো নেতা তৈরি না হওয়ায় তার হত্যাকাণ্ডের পর দলের মধ্যে দলাদলি শুরু হয়। এক পর্যায়ে দল কয়েক ভাগে ভাগ হলো,” বলেন তিনি।
এরপর ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ (মালেক) ৩৯টি এবং আওয়ামী লীগ (মিজান) দুটি আসন লাভ করে। আওয়ামী লীগের একটি অংশ আবার বাকশালকেও সক্রিয় করে।
এর আগেই দেওয়ান ফরিদ গাজী এবং আব্দুল মালেক উকিলের নেতৃত্বে দুটি অংশ হয়ে যায় আওয়ামী লীগের।
এর বাইরে দল থেকে বেরিয়ে আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ এবং এমএজি ওসমানি আলাদা দল গঠন করেছিলেন।
“শেখ মুজিব রক্ষীবাহিনী এবং অন্য বাহিনীর ওপর নির্ভর করে দেশ শাসন করেছিলেন। দলের সব ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়েছিলেন। ফলে দল হয়েছিলো মুজিব নির্ভর। এ কারণে ১৫ই অগাস্টের পর দলকে খুঁজে পাওয়া যায়নি,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মি. আহমদ।
তিনি বলেছেন, ১৫ই অগাস্ট পরবর্তী সরকার পরবর্তীকালে এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠিত হবার সুযোগ দিয়েছিলো।
এরপর দল টেকানোর জন্য দলের বিবদমান নেতারাই ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি করে ঢাকায় নিয়ে এসেছিলেন।
এরপর থেকে এ পর্যন্ত শেখ হাসিনাই দলের সভাপতি পদে আছেন।
শেখ হাসিনার পতনের পর অনেক এলাকায় ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে
২০২৪ সালের অগাস্ট পরবর্তী পরিস্থিতি
ব্যাপক ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে পাঁচই অগাস্ট ক্ষমতা ছেড়ে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেলে আওয়ামী লীগের টানা ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে।
এর পরপরই ঢাকায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু জাদুঘর, ঢাকায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ কয়েকটি কার্যালয়ে ব্যাপক হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
দেশের বহু জায়গায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়িঘর, দোকানপাটেও হামলার ঘটনা ঘটেছে।
গোপালগঞ্জে শুধু আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা ‘শেখ হাসিনাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে’ দাবি করে গত পাঁচই অগাস্টের পরপর বেশ কয়েক দফায়, কয়েকদিন ধরে বিক্ষোভ মিছিল করেছে।
শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পরপরই দলের নেতারা আত্মগোপনে চলে যান এবং দলটির কোনো স্তরের কোনো নেতাকেই আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। শেখ হাসিনাসহ দলের সব নেতার বিরুদ্ধেই বহু মামলা দায়ের হয়েছে।
এরপর গত দুইমাসে দলের নেতা ও সাবেক মন্ত্রী এমপিদের অনেককেই আটক করেছে পুলিশ যার মধ্যে আছেন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান, সাবেক মন্ত্রী আনিসুল হক, দীপু মনি, সালমান এফ রহমানসহ অনেকেই।
সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ এবং মাহবুব উল আলম হানিফসহ সহ সিনিয়র নেতারা, যাদের আটকের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি তারা কে কোথায় আছেন নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
পাঁচই আগস্ট বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভাঙার দৃশ্য
তবে আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো বলছে, ওবায়দুল কাদের এবং জাহাঙ্গীর কবির নানকসহ নেতাদের বড় একটি অংশ ভারতে চলে গেছেন।
কেউ কেউ ভারত হয়ে অন্য দেশে গেছেন। যদিও নিরপেক্ষ কোনো সূত্র থেকে এসব তথ্যের সত্যতা যাচাই করা যায়নি।
দলের কোনো নেতাকে প্রকাশ্যে দেখা না গেলেও কয়েকটি বিবৃতি গণমাধ্যমে এসেছে জাহাঙ্গীর কবির নানক, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম এবং মাহবুব উল আলম হানিফের নামে।
এছাড়া দল এবং শেখ হাসিনার অবস্থান ব্যাখ্যা করে একাধিকবার ভিডিও বার্তা দিয়েছেন শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়।
এমন অবস্থায় গত দেড় দশকেরও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগে চরম নেতৃত্বশূন্যতা দেখা দিয়েছে।
এতে সাংগঠনিকভাবে দলটি রীতিমত বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন দলটির তৃণমূলের নেতারা।
তাদের অনেকেই এখন উদ্বেগ ও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। গণমাধ্যমে কথা বলার সময় কেউ তাদের নামও প্রকাশ করতে চান না।
মহিউদ্দিন আহমদ বলছিলেন, “দুই মাস হয়ে গেছে সরকারের পতন হয়েছে। এখনো কিন্তু নেতা হিসেবে কেউ দাঁড়াতে পারছেন না। এখন শেখ হাসিনার ছেলে বিবৃতি দিচ্ছেন। কথা বলছেন। তার পরিবারের বাইরে দলের কোনো নেতাকে এখনো দেখা যাচ্ছে না।”
অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলছেন, শেখ হাসিনার আমলে যে পরিমাণ অন্যায় অত্যাচার হয়েছে তার প্রতিক্রিয়ায় এবারে দলটির অবস্থা আরও সংকটাপন্ন বলে মনে করেন তিনি।
“পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিলো। কিন্তু এবারে সরকারের পতনের পর তার সব চিহ্ন মুছে দেয়া হয়েছে। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ছন্নছাড়া হয়ে গেছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার পরপরই তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছিলেন যে, তার মার আর রাজনীতিতে ফিরবেন না।
“আমার মনে হয় এখানেই শেষ। আমার পরিবার এবং আমি – আমাদের যথেষ্ট হয়েছে,” বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন মি. জয়।
তবে কিছুদিনের মধ্যেই অবশ্য তাকে ভিন্ন সুরে বলতে শোনা গেছে, “অবশ্যই তিনি (শেখ হাসিনা) বাংলাদেশে ফিরবেন, যখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবে।” বিবিসিকে দেওয়া আরেকটি সাক্ষাৎকারে বলনে মি. জয়।
এরপর সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে গুঞ্জন শোনা গেছে, শিগগিরই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে।
যদিও পরে এ বিষয়টি আওয়ামী লীগের কোন পর্যায় থেকে নিশ্চিত করেননি দায়িত্বশীল কেউ।
-বিবিসি