অঙ্গসংগঠনসহ আ’লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন

আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে গতকাল সোমবার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। সন্ত্রাসবিরোধী (সংশোধন) অধ্যাদেশের ১৮(১) অনুযায়ী এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর আন্দোলনের মুখে গত শনিবার রাতে জরুরি সভায় উপদেষ্টা পরিষদ ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের সংশোধন অনুমোদন করে। এতে সরকার কোনো দলকে নিষিদ্ধ না করেও কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা পেয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা দরকার। তাই যে কোনো ধরনের প্রকাশনা, গণমাধ্যম, অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে কোনো ধরনের প্রচারণা, মিছিল, সভা-সমাবেশ, সম্মেলন আয়োজনসহ যাবতীয় কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো।
প্রজ্ঞাপনে আওয়ামী লীগরে কার্যক্রম নিষিদ্ধের যৌক্তিকতা প্রমাণে গত ১৬ বছরে দলটির কার্যক্রম ও জুলাই গণহত্যার ভূমিকা তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি সরকার গঠনের পর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সদস্য ও ভিন্নমতের মানুষের ওপর হামলা, গুম, খুন, হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন নিপীড়নমূলক ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সারাদেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। গত ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান দমনে গুম, খুন, পুড়িয়ে মানুষ হত্যা, গণহত্যা, বেআইনি আটক, অমানবিক নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, সন্ত্রাসী কাজ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে, যা দেশি ও আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এসব অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং অন্যান্য আদালতে মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
বিচারে প্রতিবন্ধকতা তৈরি, জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি, বাংলাদেশের সংহতি, জননিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করতে আওয়ামী লীগ ৫ আগস্টের পর ছাত্র-জনতার ওপর হামলা, উস্কানিমূলক মিছিল, রাষ্ট্রবিরোধী লিফলেট বিতরণ করছে বলে বলা হয়েছে প্রজ্ঞাপনে।
অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনার নাম প্রজ্ঞাপনে নেওয়া হয়নি। বলা হয়, বিদেশে পলাতক তাদের নেত্রী অন্য নেতাকর্মীর মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপরাধমূলক বক্তব্য দিচ্ছে। ব্যক্তি ও প্রজাতন্ত্রের সম্পত্তির ক্ষতিসাধনের প্রচেষ্টাসহ আইনশৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। এতে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। তাই মামলার বাদী ও সাক্ষীদের মনে ভীতির সঞ্চার হয়েছে। এভাবে বিচার বিঘ্নিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সার্বিকভাবে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সরকারের কাছে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ রয়েছে, আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল ও অকার্যকর করতে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত। জনমনে ভীতি সঞ্চারে সন্ত্রাসী সংগঠনের মতো বিভিন্ন বেআইনি কার্যকলাপ ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।
যেভাবে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ
সাবেক রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের দেশ ছাড়ার পর আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে গত ৮ মে রাত থেকে আন্দোলন শুরু করে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি। এতে হেফাজতে ইসলামসংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলো, ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টি, ইসলামী ছাত্রশিবির, ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশ এবং জুলাই অভ্যুত্থানকেন্দ্রিক সংগঠনগুলো ওই রাতেই আন্দোলনে যোগ দেয়। অংশ নেয় জামায়াত নেতাকর্মীরাও। প্রথম দু’দিন দলীয় অবস্থান স্পষ্ট না করলেও শনিবার রাতে সরাসরি সমর্থন জানায় জামায়াত।
আন্দোলনের মুখে শনিবার রাতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী অনুমোদন করা হয়। এতে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচারের পথ খোলে। আইনের সংশোধনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম বিচার সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত নিষিদ্ধ হলেও দলটি বৈধ সংগঠন হিসেবেই থাকছে।
আওয়ামী লীগের নিষেধাজ্ঞা ও সংকট
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন গঠিত আওয়ামী লীগ অতীতেও ১৯৭১ সালে নিষিদ্ধ হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসন আমলেই আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত হয়েছিল। গঠিত হয়েছিল বাকশাল। অবশ্য পরের বছর সামরিক আইনের সুযোগে আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত হয়। তবে আদর্শিক বিরোধে আওয়ামী লীগ (মালেক) এবং আওয়ামী লীগ (মিজান) নামে দুটি দলে ভাগ হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে আবার একীভূতও হয়।
১৯৫৮ সালে সামরিক শাসনে সব দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগও নিষিদ্ধ হয়েছিল। পরে ১৯৬২ সালে পুনরুজ্জীবিত হয়। ১৯৬৯ সালেও সামরিক আইনে অন্যান্য দলের সঙ্গে নিষিদ্ধ হয়েছিল দলটির কার্যক্রম। ১৯৮২ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সামরিক আইন জারি করে ক্ষমতা দখলের পর অন্যান্য দলের সঙ্গে নিষিদ্ধ হয়েছিল আওয়ামী লীগের কার্যক্রমও।
অতীতের তুলনায় এবারের নিষেধাজ্ঞার কারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। টানা তিন বিতর্কিত নির্বাচনে সাড়ে ১৫ বছর কর্তৃত্ববাদী শাসন কায়েম করা আওয়ামী লীগ এবার গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে তথ্যানুসন্ধানে বলা হয়েছে, জুলাইয়ের মানবতাবিরোধী অপরাধের মূল হোতা শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গসংগঠনগুলো ছিল সহযোগীর ভূমিকায়।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে নির্দোষ হলে আওয়ামী লীগের ফিরে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে দোষী প্রমাণ হলে বড় ধরনের পট পরিবর্তন ছাড়া রাজনীতিতে ফেরার সম্ভাবনা ক্ষীণ ২৪ বছর দেশ শাসন করা আওয়ামী লীগের।
নিষিদ্ধ যেসব দল সংগঠন
২০০৯ সালে সন্ত্রাসবিরোধী আইন করেছিল শেখ হাসিনা সরকারই। সমালোচনা উপেক্ষা করে ২০১৩ সালে আইনটি আরও কঠোর করে তাঁর সরকার। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনও ২০১০ সালে সংশোধন করে কঠোর করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। প্রায় দেড় দশক পর এই দুই আইনেই কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে আওয়ামী লীগকে বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার প্রাক্কালে গত ১ আগস্ট জামায়াত ও শিবিরকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
সন্ত্রাসবিরোধী আইনে অতীতে জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), হরকাতুল জিহাদ এবং হিজবুত তাহরীরকে নিষিদ্ধ হয়। গত ২৩ অক্টোবর ছাত্রলীগকেও নিষিদ্ধ করা হয়।
-সমকাল