জুলাই আন্দোলন ও একজন সাংবাদিকের ডায়েরি

সাংবাদিক আরিফ রহমান
আমি একটা বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে অনেকদিন কাজ করেছি। শুরুতে মোটামুটি ভালো থাকলেও দিনে দিনে সেই চ্যানেল বাতাবি লেবুতে পরিণত হতে থাকে। সেখানে আমার কাজ করা হয়েছে পাঁচ বছর।
এই পাঁচ বছরে অন্তত বিশবার আমাকে অফিসের উপর মহল থেকে ফোন করিয়ে ফেসবুক স্ট্যাটাস ডিলেট করানো হয়েছে। একবার তো এমন হল যে একটা স্ট্যাটাস দেয়ার পর আমাকে আমার বস ফোন দিয়ে বললেন আমার আপাতত কিছুদিন অফিসে আসা লাগবে না।
ইন্টারনাল অনেক তর্ক-বিতর্কের পর এক মাস বসিয়ে রেখে আমাকে পুনঃবহাল করা হয়। পাঁচ বছরে এই ঘটনা তিন-চার বার হয়েছে। কখনো এক মাস, কখন দুই সাপ্তাহ, কখনো ৫ দিন অফিসে আসতে মানা করে দিতো। আর আমিও ছিনাল মাগীদের মতো অপমানে অপমানে জর্জরিত হয়ে সেই অফিসেই ফিরে গেছি। যাবো কই? সবখানে তো একই অবস্থা।
দুই সাপ্তাহ কোন কারণ ছাড়া অফিস না করে লজ্জিত অপমানিত হয়ে অফিসে ফিরে গিয়ে দেখেছি বিভিন্ন পর্যায়ের বসেরা ছাদে আমোদে হাসছেন। বলছেন কিরকম জব্দ করা গেলো, বলছেন পাকনামি ছুটায়া দিতে পারলেন ওনারা।
একবার চ্যানেলের এমডির রুমে ব্যক্তিগত মিটিং-এ এক সিনিয়ার নিউজ এডিটর আমাকে জামাতের এজেন্ট বলে শনাক্ত করে ভাষণ দিলেন। সেই মিটিং-এ উপস্থিত আরেকজন আমাকে ফোন করে সেই কথা শোনালেন। ওনাদের মিটিং শেষ হবার পরেই অনিবার্য ভাবে ফোন আসলো আমি যেন অফিসে না আসি কিছুদিন, একটা সমস্যা হয়েছে।
আরেক সিনিয়র সহকর্মী, জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন। প্রায়শ আমার সাথে অশিক্ষিতের মতো অযাচিত রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা করার চেষ্টা করেন। আলাপের শুরুতে বলেন, ‘আমরা যদি নিরপেক্ষভাবে দেখি’। সেঞ্চুরি মানিকের সাথে একত্রে রাজনীতি করা ছোটভাই আমারে বলেন পরিস্থিতি নিরপেক্ষভাবে দেখতে।
জু
লাই আন্দোলনের সময় অফিসের ছাদ থেকে দেখতাম মিছিল আসছে, পুলিশ ছত্রভঙ্গ করছে। ধুমায়িত চায়ের কাপ হাতে সবচেয়ে উর্বশী উপস্থাপিকাকে দেখেছি বিরক্ত হয়ে বলছেন- ‘এরা কিসের ছাত্র, গাঁজা খেয়ে এসেছে দেখেই বোঝা যাচ্ছে।’
একটা গান্ডু শুয়োর কিছুদিন আমার বস ছিলেন। আমি যেদিন প্রথম রাজপথে লাশ নিয়ে মিছিল দেখে অফিসে ফিরছিলাম সেইদিন অফিসে ঢুকে দেখি উনি কুকুরের মতো চিৎকার করতে করতে বলছেন- ‘শেখ হাসিনা কাউকে রাজাকার বলে নাই’। বলছেন, ‘বিটিভি ভবনে সন্ত্রাসীরা হামলা করলে, মেট্রোরেলে আগুন দিলে ১০০০ মানুষকে গুলি করে হত্যা করাই উচিত’। আমি সাধারণত গান্ডুদের সাথে তর্ক করি না। সেইদিন আমি চিৎকার করতে করতে কেঁদেই ফেলেছিলাম। উনি হয়তো সেইদিন আমার গায়ে হাতই তুলতেন। সহকর্মীদের কারণে পারেন নাই।
এখানে যতোজনের কথা বললাম তাদের সবাই চাকরিতে বহাল আছেন। অনেকের প্রোমোশন হয়েছে। অনেকের বেতন বেড়েছে। স্ত্রী-সন্তানদের সাথে সুন্দর সুন্দর ছবি দেন। ঘুরতে যান।
আমিই কেবল ঘুমাইতে পারি না। উত্তরা-যাত্রাবাড়ী, ভ্যানে স্তুপ করা লাশের দৃশ্য স্বপ্নের ভেতর খালি দেখতে থাকি। বমি করি। কিন্তু যেই লোকটা বলল শেখ হাসিনা ঠিক কাজটাই করেছেন, সেই লোকটা কয়দিন আগে বিয়ে করলো। সুখের সংসার বাঁধলো।
ফারুকি সাহেবের আগে-পরের বহুবিধ সমস্যাদায়ক আলাপ নিয়ে আমিই সারাদিন সমালোচনা করতে পারবো, কিন্তু গতকালের সংবাদ সম্মেলনে যেটা ঘটলো সেটাকে যারা সামান্য একটা প্রশ্ন হিসেবে দেখছেন তারা আসলে গত এক যুগে বাংলাদেশের মিডিয়াপাড়ার ভেতরটা দেখেন নাই।
জুলাইয়ের পর রাস্তাঘাট অফিস-আদালত অল্প-বিস্তর পরিষ্কার হলেও ওয়ান্ডারল্যান্ডের মতো মিডিয়া হাউজগুলোর অধিকাংশ সাংবাদিক আওয়ামী লীগের একান্ত তাবেদার হিসেবে ফাংশন করে যাচ্ছে। তারা হয়তো মুখ গোমড়া করে ইউনূস আর বিএনপির নিউজটা দিচ্ছে, কিন্তু একটা নিউজ লিখেই ক্যান্টিনে বিড়ি টানতে টানতে ছিদ্রান্বেষণ করছেন।
আমার কথায় কেউ কষ্ট পাইয়েন না। হাসিনার আমলে সামান্য স্ট্যাটাস দিয়ে কিছুদিন পরপর চাকরি অনিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পরের রাতগুলো যেই মানসিক যন্ত্রণায়- যেই ট্রমায় কাটাইতাম, আমার পক্ষে কালকের বিষয়টাকে কেবল একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা, কিংবা মত প্রকাশের বাধা হিসেবে নেয়াটা একটু কষ্টকর। মাফ কইরেন।