ত্যাগী-নির্যাতিত ও অভিজ্ঞদের অবমূল্যায়নে ক্ষোভ অসন্তোষ

দল পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় এবার কেন্দ্রীয় কমিটিতে বড় ধরনের রদবদল করছে বিএনপি। এতে অনেক ত্যাগী, অভিজ্ঞ ও নির্যাতিত নেতাকে ‘গুরুত্বহীন’ পদ দিয়ে অবমূল্যায়নের অভিযোগ উঠেছে। আবার অনেক নেতাকে ‘পুরস্কৃত’ করেছেন দলটির হাইকমান্ড। বিগত সরকারবিরোধী আন্দোলনে ‘ভূমিকা’ মূল্যায়ন করে এই পদায়নের দাবি করা হলেও বাস্তবে ঘটেছে এর উল্টো। যারা মামলা-হামলার শিকার হননি, যারা নির্যাতিত হননি– এমন নেতাদেরও দেওয়া হয়েছে পদোন্নতি। এতে ক্ষোভ ও অসন্তোষ বাড়ছে দলটির ভেতরে। এমন পুনর্গঠন প্রক্রিয়াকে ‘তামাশা’ বলছেন দলটির অনেকে। আবার কেউ কেউ এ সিদ্ধান্তকে ‘আত্মঘাতী’ মনে করছেন। কতিপয় নেতার নিজস্ব বলয় শক্তিশালী করতে হাইকমান্ড দিয়ে এমন পুনর্গঠন করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেছেন কোনো কোনো নেতা।
শনিবার বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টামণ্ডলী এবং জাতীয় নির্বাহী কমিটির ৪৫ নেতাকে বিভিন্ন পদে নতুনভাবে রদবদল করা হয়। দলটির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়। বেশ কয়েকজন নেতাকে সম্পাদকীয় থেকে নির্বাহী কমিটিতে পদায়ন করা হয়েছে। এর আগে বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ, চট্টগ্রাম, বরিশাল মহানগর কমিটি বিলুপ্ত করে বিএনপি। একই সঙ্গে যুবদলের কমিটিও ভেঙে দেওয়া হয়।
বিএনপির অনেক নেতাকর্মীর অভিযোগ, দল পুনর্গঠনের এ প্রক্রিয়ায় যারা কারা নির্যাতন ও মামলা-হামলার শিকার এবং রাজনৈতিক মামলায় সাজাপ্রাপ্ত, দলে তাদের কম গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়া হয়েছে। চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলে ১০ জনকে যুক্ত করা হয়েছে। তারা এত দিন দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে বিভিন্ন পদে ছিলেন। আগের কমিটির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা করা হয়েছে। অথচ এ নেতা গত ২৮ অক্টোবরের পর আন্দোলনে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যান। তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে ৩৫৭ মামলা। গত ১৭ বছরে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ছয় বছর কারাগারে ছিলেন তিনি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে একটি মামলায় তাঁর তিন বছরের সাজা হয়। যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, মজিবর রহমান সরোয়ার, হারুন অর রশিদ, আসলাম চৌধুরীকেও উপদেষ্টা করা হয়েছে। এর মধ্যে ব্যারিস্টার খোকন সুপ্রিম কোর্ট বারের নির্বাচিত সভাপতি। এ নির্বাচন কেন্দ্র করে সিন্ডিকেটের রোষানলে পড়েন তিনি। বরিশাল বিএনপির রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রিয় করার পর কেন্দ্রীয়ভাবেও সরোয়ারকে গুরুত্বহীন করা হলো। আর ছাত্র রাজনীতিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বন্দ্বকে ব্যবহার করা হয়েছে সাবেক এমপিহারুনের বিরুদ্ধে।
নেতারা আরও অভিযোগ করেন, একইভাবে বরিশালের সাবেক এমপি ও মিডিয়া সেলের প্রধান জহির উদ্দিন স্বপন, সিলেট বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সাখাওয়াত হাসান জীবন, সহ-আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক বেবী নাজনীন এবং সহতথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক খালেদ হোসেন চৌধুরী ফাহিনকেও উপদেষ্টা করা হয়েছে। একেবারে ছাত্রদলের তৃণমূল থেকে উঠে আসা রাজশাহী বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুকেও উপদেষ্টা করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে ১৪৭টি মামলা রয়েছে। ওয়ান-ইলেভেনের একটি মামলায় তাঁকে ১৭ বছর সাজা দেওয়া হয়েছে। ১৯৮২ সালে শুরু রাজনীতিতে প্রায় সাত বছর কারাগারেই কেটেছে তাঁর। দলের একটি সিন্ডিকেটকে সুযোগ করে দিতে এবং রাজশাহী বিভাগকে নিষ্কণ্টক করতে তাঁর মতো ত্যাগী রাজনীতিবিদকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হলো। আর দুলুর অনুসারীদের মতে, তাঁকে রাজনীতিতে বলি দেওয়া হলো।
অবশ্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল সমকালকে বলেন, দল যেটা ভালো মনে করেছে, সেটাই করেছে। এতে তাঁর কোনো রাগ-ক্ষোভ নেই। রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেন, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে তাঁর কোনো বক্তব্য নেই।
কমিটি রদবদল নিয়ে বিএনপির বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতার সঙ্গে কথা বলেছে সমকাল। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, দলের জন্য শত শত মামলা খেয়ে, জীবনের সোনালি সময় বিসর্জন দিয়ে আজ চূড়ান্ত অপমান হতে হয়েছে।
দলের বিশেষ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ড. আসাদুজ্জামান রিপনকে ভাইস চেয়ারম্যান পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। দলের সাংগঠনিক সম্পাদক থেকে যুগ্ম মহাসচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন আব্দুস সালাম আজাদ, সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স ও শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী। সহসাংগঠনিক সম্পাদক থেকে পদোন্নতি পেয়ে সাংগঠনিক সম্পাদক হয়েছেন কাজী সাইয়েদুল আলম বাবুল (ঢাকা বিভাগ), সৈয়দ শাহীন শওকত (রাজশাহী বিভাগ) ও শরীফুল আলম (ময়মনসিংহ বিভাগ)। এ ছাড়া সমবায়বিষয়ক সম্পাদক জিকে গউছকে সাংগঠনিক সম্পাদক (সিলেট বিভাগ) করা হয়েছে। দলের প্রচার সম্পাদক করা হয়েছে সদ্য বিলুপ্ত কমিটির যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকে। কাজী সাইয়েদুল আলম বাবুলকে গত ১১ ফেব্রুয়ারি সহসাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছিল। তিন মাসের মাথায় তাঁকে আবার পদোন্নতি দেওয়া হলো।-সমকাল
এবিসিবি/এমআই